সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০১৬

শাফিনূর শাফিন

অভিসার


আতর আর আগরবাতির ধোঁয়া ওঠা পূর্বগন্ধে
আমার মৃত্যু শুয়ে পড়েছে দেহে
ঝুঁকে পড়ছে যেন ঝড়ো কুঁজো মেঘ
তুফান তুলবার অপেক্ষায় নিয়েছে শরণ

এসো প্রিয়তম সাঁতার, ডুবে যাই
ক্লোরিন জলস্রোতের আলিঙ্গনপাশে
বিহ্বল করে দিয়ে তাঁর দুর্ভেদ্য প্রাচীর,
অপ্রতিভ নখের আঁচড়ে এঁকে যাই
বিপরীত এক খরস্রোতা নদী

উড়াল-দিনরাত্রির ছায়ায় মিশে আছে
আদিম সম্মোহনে বিস্মৃত চুম্বন
এসো অভিসার, পাশে এসো
দেখো, ডুবে যাওয়ার কি ভীষণ ভয়
তবু সাঁতার জানি নি কখনো!

প্রহেলিকা


বিচূর্ণ বৃষ্টির আধুলির মতো
ঝরে পড়া ফোঁটা থেকে
নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে
আমাদের শরীর ঢুকে পড়েছিল
ভুল সময়ে, ভুল শহরের উপকণ্ঠে
আসহাবে কাহ্ফের কুণ্ডলী পাকানো
ঘুমের ভিতর লুকোনো পবিত্রতম
সাতটি পাপ আর হারানো
প্রিয় কুকুরের খোঁজে

জঠর ঠেলে বেরিয়ে
আসছিল রক্তজবার বোঁটা
খুলে রাখা ঘুমচোখ
যেন ছক কেটে এগিয়ে যাবে
পথ খুঁজে না পেয়ে
আরও দেড় হাজার বছর
আমাদের জন্মান্তর

কামড়


তোমার কানের লতিতে ইন্দ্রাণীর দাঁতের দাগ লেগেছিল। ইন্দ্রাণীর বাচ্চার নাচের ভিডিওতে  হাততালি দেয়ার সময় ঝকঝকে  দাঁত বের করে ও হেসে উঠতেই আমার  আড়চোখ তোমার কানের লতিতে অদৃশ্য সেই দাঁতের কুটকুট দেখতে পাচ্ছিল।

ইমতিয়াজ মাহমুদ



হারুন


বারান্দায় অনেক রোদ
হারুন আপনার গা পুড়ে যায়, তাও বসে থাকেন
সাত তলায়
রেলিং
নাই
আপনার বউ রোদে চাদর শুকাতে আসে
আপনি বসে থাকেন, আপনার গা পুড়ে যায়
আপনার বউ চাদর উল্টাতে যায়
হারুন আপনার তখন মনে হয়
সে বারান্দা থেকে পড়ে যাবে
রেলিং নাই
আপনার গা পুড়ে যায়
আর আপনার বউ চাদর উল্টে
পড়ে
যায়
সাত তলা থেকে
‘হারুন! আপনার বউকে ধরুন!’
আপনি ধরতে যান। চাদর ধরেন; সে রাস্তায়।

২___
আপনার বউয়ের জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে
আবার
চলে
যায়
তাও
হাসপাতালে;
চিরতরে
হারুন কিছু বোঝার আগেই পুলিশ
আপনাকে ধরে নিয়ে যায়
থানায়
আপনার বউ বলে গেছে
আপনি তাকে ধাক্কা মেরেছেন।

৩___
মানুষ কতটা হারামী হতে পারে বারান্দা
থেকে বউ না পড়লে তা বোঝাই যায় না
এক কাগজে লিখেছে টাকার জন্য খুন,
এক কাগজে লিখেছে যৌনবিকৃতি;
এক কাগজে লিখেছে আপনার
এক কাগজে লিখেছে দুজনারই
আপনার ছবিতে ছবিতে ছেয়ে গেছে মহল্লার দেয়াল;
হারুন, পাড়ার ছেলেরা উৎসবটা হাতছাড়া করতে চায় না।

৪___
আপনি দেখতে পান
কেউ আপনার সত্য কথাটা বিশ্বাস করে না
পুলিশ অথবা আপনার মা;
আর তখন আপনার মনে হতে থাকে
হয়ত আপনিই ভুল বলছেন;
হয়ত আপনিই ধাক্কা দিয়েছেন
রিমান্ডের তৃতীয় দিন আপনি স্বীকার করেন
অভিযোগ সত্য
আপনি দোষী,
হারুন, খুনের বিচার ফাঁসি!

৫___
মরে যাবার সময় আপনি মুহূর্তের মধ্যে গোটা জীবন
স্থিরচিত্রের মতো দেখতে পান। আর তখন খুব পরিস্কার দেখতে
পান আপনি বারান্দায় বসা আর চাদর উল্টে আপনার বউ
সাত তলা থেকে পড়ে যাচ্ছে; আপনি বুঝতে পারেন
কী অন্যায় আপনার সাথে করা হয়েছে
কিন্তু ন্যায়বিচার কোথায় পাবেন?
হারুন, এখন খোদার কথা ভাবেন।

___
পুলিশের কাছে মিথ্যা বলার
অপরাধে
খোদা
আপনাকে দোজখে পাঠালো।
যে দোজখ আপনার অনেক পরিচিত
দোজখে অনেক আগুন
তাতে
আপনার
গা
পুড়ে
যায়
যেন সাত তলার বারান্দায় বসে আছেন
আপনার বউ বারান্দায় আসে
আপনার মনে হয় সে
বারান্দা
থেকে
পড়ে
যাবে
রেলিং নাই
হারুন! পড়ে যাবার আগে ধরুন!

সম্পর্ক


আমার বাবাকে একটি এনজিওর কাছে ভাড়া দিয়েছি।
প্রতি সপ্তাহে পনেরশ টাকা পাওয়া যাবে। তার বয়স
কম। এই মার্চে ৭২ হবে। এনজিওর পরিচালক বলেছে
বয়স ৮২ হলে আরও সাতশ টাকা বেশি পাওয়া যেত।
বাবাকে মাঠকর্মীর কাছে তুলে দেয়ার সময় তার চোখ
ভেজা ছিলো। চোখ মুছে উনি বলছিলেন, তুই পারলি?
আমি চুপ থাকি। এর উত্তরে আর কীইবা বলা যায়!
মাঠকর্মী তাকে পিকআপে ওঠানোর সময় তিনি আমার
মৃত্যু কামনা করলেন। আমি অবশ্য তার দীর্ঘায়ু চাই,
বাবাকে ভাড়া দেয়া ছাড়া; আমার কোনো রোজগার নাই!

শূন্যস্থান


কবিতার দুটি লাইনের মধ্যে এতটুকু শূন্যস্থান রাখতে
হয় যেন তার মধ্যে একটা সূর্য উঠতে পারে আর
সূর্যের আলোয় একটা লোক হকার্স মার্কেটে কমলা
রঙের একটা মশারির দরদাম করতে পারে। দরদাম
শেষ হবার আগেই
এই
কবিতা
পরের
লাইনে
চলে যাবে যেখানে দেখা যাবে লোকটা তারও পরের
লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে ছুটছে। কেননা একটু
আগে তার পকেটকাটা গেছে। সে পকেটমারের পেছনে
দৌড়াচ্ছে। আর তার পেছনে দৌড়াচ্ছে আরও দশজন।
(ঐ দশজন অবশ্য তাকেই পকেটমার সন্দেহ করছে!)
দৌড়াতে
দৌড়াতে
লোকটা
একটা ঠেলাগাড়ি, দুইটা ভ্যান আর তিনটা রিক্সা পেছনে
ফেলে এখন একটা বাসের পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে আর
অবাক ব্যাপার যে বাসটাও তার সামনে সামনে দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে
এভাবে কবিতা পরের লাইনে গেলে দেখা যায়
ঐ লোকটার চেয়ে
পেছনের দশজন ভালো দৌড়েছিল
আর
পকেটকাটার
অপরাধে লোকটার লাশ ফুটপাতে পড়ে আছে;
তবু তার
দৌড় থামানো যায় না, কেননা
মানুষ জীবনভর নিজের লাশের পেছনে দৌড়ায়,
সে লাশের যত কাছে যায়
লাশ তত দূরে সরে যায়
লোকটা
তাও
দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে লোকালয়
আর পাহাড় অতিক্রম করে এখন একটা
জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াচ্ছে
আর তার সামনে
দৌড়াচ্ছে একটা বাঘ
লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে
কবিতার
পরের
শূন্যস্থানে বাঘ থেমে যায়। আর তার পেছনে
থেমে যায় লাশ। ফলে লোকটা তার লাশটাকে ধরে
ফেলে। আর এখন সে বাঘটাকে অনুরোধ করছে
যেন দয়া করে তার লাশটা খেয়ে ফেলে।
বাঘ বলল ‘কী নাম?’
লোক বলল ‘জামান’
বাঘ বলল ‘জামান, নিজের টাকা চুরি করে
যে লাশ হয় তাকে আমার খাবার রুচি হয় না’
এই বলে বাঘ কবিতায়
মিলিয়ে যায় আর
লোকটা তার লাশ নিয়ে ফের দৌড়ানো শুরু করে
তার
মাথার উপর
দৌড়ায়
শূন্য থেকে বের হয়ে আসা চাঁদ
লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে
এরপর
চাঁদ ডুবে
গেলে কবিতার দুই লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে সূর্য ওঠে
যার আলোয় লোকটা হকার্স মার্কেটে মশারি কিনতে যায়
আর লাশ হয়ে পুনরায়
এতদূর
আসে
(অথচ কবিতার শেষেও থাকে এক দীর্ঘ শূন্যস্থান
যেখানে অনায়াসে একটি কবর রচনা করে
চক্র ভাঙা যায়)
‘জামান?’
‘জ্বি’
আপনার লাশটা ঐ শূন্যস্থানে নামান!’

মলয় রায়চৌধুরী



নেভো মোম নেভো


আপনি আমার প্রিয় নারী, যদিও শুধুই শুনেছি ঘুমন্ত কন্ঠের কালো
ফিল্মে দেখেছি, আগুন-নগ্নিকা,  বুক দুটো অতো ছোটো কেন
দুঃখ হয় না কি? আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বুক ছোটো বলে
হত্যা করতে গিয়ে কিছুটা ঝুঁকলেন নয়তো বুক উঁচু করে বলতেন
যা করি তা করি প্রেত তোর তাতে কি তুই কি ঘুমের ইন্দ্রজালে
শুধু বুক খুঁজে বেড়াস নাকি! সত্যিই তাই, আপনার ঘুমে ঢুকে
তাছাড়া কি খুঁজবো বলুন, ফেরার ট্যাক্সিভাড়া? গ্যাসের রসিদ?
যা ইচ্ছে করুন আপনি, জেনে নেবো, চলন্ত গাছেরা বলে দেবে,
না জানলেও আকাশ তো ভেঙে পড়ছে না, আপনি আমার প্রিয় নারী
মন খারাপ করে দিলেন আজকে বৃষ্টির দিনে, ছাতাও আনিনি
আপনার পাশ দিয়ে যেতে যেতে যেতে ছাতার আড়াল থেকে আপনার
ছোট্টো দুটো বুক জরিপ করে নিতে পারি, ব্র্যাঙ্কোর প্রেত আমি
ছোরাদুটো নিলেন দুহাতে তুলে, মনে হয়েছিল বুকের গরবিনি, হত্যা
নেহাতই অযুহাত, কেউ তো আর মনে রাখবে না, উনিও জানেন
তোমাকে দেখেই চুমু খেতে ইচ্ছে করেছিল, না না, হাঁমুখের ঠোঁটে নয়
পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন
নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না
খুলে বলি আপনাকে, আমি কিরকমভাবে নারীকে খুঁজি তা বলছি শুনুন।
যেমন ঘোড়দৌড়ের জুয়াড়িরা ঘোড়ার রেসবই খুঁটে-খুঁটে পড়ে
আমার ভেতরে সেরকমই পোষা আছে অভিজাত কয়েকটা অসুখ
বুঝলেন, যখন প্রথম পড়ি প্রেমে পড়ে গিসলুম নগ্ন আপনার!
লেডি ম্যাকবেথ! আহা কী শঙ্খিনী নারী, কী ডাগর রক্তময়ী চোখ
ঘুমন্ত হেঁটে যাচ্ছো মৃত্যুর মসলিনে সম্পূর্ণ পোশাকহীন কোনো খেয়াল নেই
চেয়েছি জড়িয়ে ধরতে, বলতে চেয়েছি, লেডি, লেডি, নগ্ন পশ্চিমে
একটা চুমু শেষবার দাও, পুরস্কার নিয়ে ডাইনিরা দাঁড়িয়ে রয়েছে
রক্তাক্ত ছোরার সঙ্গে কথা বলো, বুকের নির্দয় ওঠা-নামা, লেডি
ম্যাকবেথ, ওই যিনি ছোটো বুকে মনটা খারাপ করে ফিরছেন বাড়ি
ওনাকে উৎসাহিত করো, বলো, আরবের সমস্ত আতর ধুতে পারবে না
হত্যার মিষ্টি গন্ধ, যেমনই লোক হোক সে তো তার নিজস্ব দৈত্যের সৃষ্টি
তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা
ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে তোলা ঝর্ণাঝংকার
আপনার নগ্নতার ব্যক্তিগত ছন্দ লেডি ম্যাকবেথের মতো হাঁটছেন
কলকাতার রাস্তা দিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, আমাকে চিনতে পেরেছেন?
আমি ব্যাঙ্কোর প্রেত, প্রতিটি হত্যাদৃশ্যে উপস্হিত থেকে
বুকের বর্তুলতা মাপি, যবে থেকে স্কুলপাঠ্য বইয়ে দুরূহ লেগেছিল
লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে
বসে আছো, স্কুল ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি
ঘুমন্তকে নয় ঘুমকে খুন করেছিলে তুমি, চিৎকার করছিলে
“কে জানতো বুড়ো লোকটার গায়ে এতো রক্ত এতো রক্ত ছিল!”
এসবই আপনার নারীত্বের রক্ত ছোট্টো দুটো বুকের দুঃখের
ভাববেন না বেশি, যৌবন ফুরোবার সঙ্গে এই দুঃখ চলে যাবে
তখন দেখবেন ক্লিটোরিস সাড়া দিচ্ছে না, রসশাস্ত্রহীন দেহ
আদিরস প্রথমে লোপাট, ঘুমন্ত হাঁটবার আহ্লাদ নামছে দুঃস্বপ্নে
আপনার ছোটো বুক ছোট্টোই থেকে যাবে যতোই উদার হোন
ভিখিরি দেখলেই বটুয়াতে কয়েনের ওজন কমান, লেডি ম্যাকবেথ
ছাড়বে না, উচ্চাশার কি দুর্দশা, হাতে রক্ত, নেভো  মোম নেভো

বিদারের নসট্যালজিয়া


কেমন করে বেঁচে থাকতে হবে শেখা বেশ কঠিন, শেখা মানে ‘চলে যাচ্ছে
         টাইপ’ নয়, যা বলতে চাইছি, অভ্যস্ত হতে সময় লাগে, তাছাড়া
         গর্ত দেখলেই কান পাততে ইচ্ছে করে
ঘটনার, জিনিসের, কথার মানেগুলোকে একজায়গায় জড়ো করে
         প্রাসঙ্গিক মানুষদের বুঝতে পারা আরও কঠিন, আমি চেষ্টা করি
         লেগিংস-পরা মেছোবক, এই  কপাৎ, ঢুকেছে কি ? কষ্ট হল?
দেখেছি, গাঁজা-চরস ফোঁকা ছেড়ে দেবার পর বেশ কিছুকাল শোকে
         আক্রান্ত ছিলুম, তার কারণ নিজেকে খারাপ প্রমাণ করা আর
         বাইশ শতকের চুমু এরকমই শামুকের নিঃশর্ত লালা
প্রমাণ করার পর তার প্রভাবকে সহ্য করা সহজ ছিল না,  গোপনীয়তা
         কাউকে বলার মতন নয়, যাবতীয় ভোগান্তি একার, যেমন ধরুন
         ইংরেজিতে ‘পুসি’ শুনতে ভাল্লাগে বাংলায় বড্ডো অশ্লীল
যে কমিউনিস্টরা রুবলের লোভে রাশিয়ায় গিয়ে ডেরা বেঁধেছিল
         আধপেগ ভোদকা চুইয়ে চেটে দেখেছেন নাকি
         বাবা তাদের কাউকে ক্ষমা করতে পারেননি, বলতেন লেনিনখোসা
অথচ বাবা জানতেন আমি উপন্যাস লিখছি আর বানানো চরিত্রে
         বেমালুম ঢুকে পড়ছি, চরিত্রগুলো জানতে পারছে না, রেগে
         বিশেখুড়োর তোলা কাকিমার নগ্নিকা ফোটোর অ্যালবামে
যাওয়ায় আনন্দ আছে, অলৌকিক ক্ষিপ্তাবস্থাকে ন্যায্য মনে হয়, নয় কি
         যে পরিবারগুলো নিজেদের মার্জিত গুণের মালিক মনে করতো
         এমন ডবকাগুদো পাৎলিকোমর যাকে নিয়ে ছেলেরা লড়ে না
মা তাদের পছন্দ করতেন না, বলতেন, ওদের সঙ্গে মিশিসনি, আমার
         বাবা-মা বেশ রাশভারি ছিলেন, সৎ থাকার কথা বলতেন, আমি
         লেসবিয়ান কমিউনিস্টের প্রেমে পড়লুম, যখন ২০-৩০ বছরে
এখনকার মতন এসকর্টস আর হাইফাই মডেল যৌনকর্মীর উড়ুক্কু
         চল শুরু হয়নি, আমার লুঙ্গি-রুমমেট করিম গ্যাসের উনুনে
         মুর্গিটা পুড়িয়ে তারপর রাঁধতো যাতে আগুন রক্ত খেয়ে নেয়
পাঁঠা কিনে আনলে জলে ভিজিয়ে রাখতো, যাতে রক্ত জলে মিশে যায়
         মইনুদ্দিন মৌলবি বলেছিলেন, অমন নির্দেশ কোথাও নেই, স্বাদ
         শেষকালে বিকেলের কন্ঠস্বর কাঁকুরে হয়ে যাবে, স্বপ্নেরা  বিমূর্ত
ওইখানে ঠোঁট রেখে দপদপ ধ্বনি খাই ওগো মাংসল আওয়াজ বেজে ওঠো
         নিয়ানডারথাল চুলে ঢাকা মাসান্তে চুনির নদী পোখরাজি অবরেসবরে
         ফেঁপে কেঁদে ওঠো জয়-মা আঠাকালী বাইসাইকেল দেহ
এক টনের আঠারো ডিগ্রি শীতে ডিউ ডেটের আগে পিল খেতে হবে
         দেহের টাইমফ্রেম সাকুল্লে তিরিশ বছর ধরো
         কতোজন পুরুষের মাংসখণ্ড এলো আর গেলো ভেবেছো কখনো?
চব্বিশকে ছয় দিয়ে গুণ করুন আর তাকে তিরিশ দিয়ে এটা মিনিমাম

উর্বশীর ডেথ সার্টিফিকেট


বললুম...হ্যাঁ...পুরো শরীরটাই দেখতে চাই...চাদর সরিয়ে দিন...ডোম বলল ‘তার জন্য টাকা লাগবে’...লাশ চিনতে পুরো শরীর দেখার দরকার হয় না...আমার দরকার আছে, বললুম...মুখ তো বহুবার দেখেছি...শরীর দেখতে দেয়নি...বুকও নয়...আর ইয়ে...মহিলা ডাক্তার বলল, কান্টও নয়, তাইতো...লজ্জা পাচ্ছেন মর্গে ঢুকেও...কেমন প্রেমিক আপনারা...বললুম, নাহ, আমি প্রেমিক বই...ভেতরের জামা পরত না ইজের পরত না জানি...নিজে গান গাইতো না...শুনে-শুনে নাচতো...ঘামতো বলে লনজারি পরতো না...ত্বকে র‌্যাশের ভয়ে...কুড়িজন মরা মানুষের গন্ধ...পাঁঠা কিনতে এসেছি যেন...তাহলে আপনি ওনার কে হন...আমি ওনার মাছরাঙা ফিঙেফড়িং দাঁড়কাক পলাশফুল পানকৌড়ি যা ইচ্ছে লিখতে পারেন...যমালয়ের দুর্গন্ধ...উনি নিজের নাম উর্বশীতে দুটো ব ব্যবহার করতেন না একটা...পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়ে য-ফলা দিতেন কিনা জানেন...ভালোবাসার ন্যারেটিভে এগুলো কি অবান্তর প্রশ্ন নয়...শহুরে লজ্জা ঢাকতে পকেট থেকে নিপ বের করে এক ঢোঁক...শ্বাসের স্মৃতি বলতে ওর ‘না’ বলবার প্রতিভা ছিল...নিজেকে এড়াতে আয়না দেখতো না...পোস্টমর্টেমের সময়ে যোনির আর বগলের চুল কাইন্ডলি শেভ করে আমায় দেবেন...ডেথ সার্টিফিকেটের সঙ্গে রেখে দেবো...এটুকুতো অনন্ত প্রাপ্য...এই কবিতাটা কোথায়  গিয়ে থামবে...সুন্দরবনের মোহনায়...ছাই ভাসুক...ছাই ভাসুক...ভেসে যাক কুমিরের ঝাঁকে...

অবন্তিকার  শতনাম 


আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া — বাঁদিকেরটা আদর করলেই গোলাপি হয়ে যায় —  ডানদিকেরটা আদর করলেই হলদেটে রঙ ধরে — বাঁদিকের বোঁটার নামকরণ করেছি কুন্দনন্দিনী — বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে — ডানদিকের বোঁটার নাম ও নিজেই রেখেছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সে লোকটা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ডিটেকটিভ — ডিটেকটিভ বই পড়তে ওর জুড়ি নেই —  ছুঁলেই কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই — যোগেন চৌধুরীর আঁকা ঝোলা মাই ওর পছন্দ নয় — প্রকাশ কর্মকারের আঁকা কালো কুচকুচে মাই ওর পছন্দ নয় — পেইনটিঙের নাম রাখা গেল না — যোনির কি নাম রাখবো চিন্তা করছিলুম — অবন্তিকা চেঁচিয়ে উঠল পিকাসো পিকাসো পিকাসো — পিকাসোর যোনির কোনো আদল-আদরা নেই —  কখনও বাদামি চুল কখনও কালো কখনও কিউবিক রহস্য — তাহলে ভগাঙ্কুরের — ও বলল সেটা আবার কি জিনিস — ওর হাত দিয়েই ছুঁইয়ে দিতে বলল অমঅমঅমঅম কি দেয়া যায় বলোতো — পান্তুয়া চলেবে — ধ্যুৎ — রস মানেই পান্তুয়া নাকি আরও কতোরকমের মিষ্টি হয় — ছানার পায়েস — নারকেল নাড়ু — রসমালাই — নকশি পিঠা — রাজভোগ— লবঙ্গলতিকা — হলদিরামে ভালো লবঙ্গলতিকা পাওয়া যায় — আমি বললুম স্বাদটা কিছুটা নোনতা — ও বলল দুর ছাই আমি নিজে টেস্ট করেছি নাকি যাকগে বাদ দে — হ্যাঁ — এগোই — পাছার কি দুটো নাম হবে — ডিসাইড কর — ডিসাইড কর — তুই কর আমি তো দেখতে পাচ্ছি না — না না ফের ফের — লাবিয়া নোনতা হলেও ওটার নাম দিলুম গোলাপসুন্দরী — পারফেক্ট হয়েছে — তাহলে পাছার একটাই নাম দিই নরম-নরম কোনো নাম — পাসওয়র্ড — ঠিক — এর নাম দেয়া যাক পাসওয়র্ড — ধ্যাৎ — পুরো রোম্যানটিক আবহাওয়া ফর্দাফাঁই করে দিচ্ছিস — গ্যাস পাস হয় বলে পাসওয়র্ড হতে যাবে কেন — ছিঃ — তাহলে এর নাম হোক গরমের ছুটি — গরমে বেশ ভাল্লাগে পাউডার মাখিয়ে পাছায় হাত বোলাতে — ওকে — তারপর — ঘুমোবো কখন — বাঁ-উরুর নাম দিই ককেশিয়া — ডান-উরুর নাম দিই লিথুয়ানিয়া — রাশিয়ানদের উরু দারুণ হয় বিশেষ করে শীতকালে যখন ওরা চান করে না — ভোদকা খেয়ে ভরভরিয়ে  প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে গন্ধ ছাড়ে — শুয়েছিস নাকি কখনও রাশিয়ান মেয়ের সঙ্গে — না কল্পনার যুবতীদের ইচ্ছেমতন হ্যাণ্ডল করা যায় — ছাড় ছাড় — এগো — মানে — নামতে থাক — তাড়াতাড়ি কর নইলে গাধার দুলাত্তি দেবো — তাহলে পায়ের নাম রাখছি জিরাফ — বামপন্হী জিরাফ আর দক্ষিণপন্হী জিরাফ — এবার ওপরে আয় — মুখে — ঠোঁট ? — ঠোঁটের নাম দিই আফ্রিকান সাফারি — আচ্ছা! ঠোঁটের নাম আফ্রিকান সাফারি ? — ব্লোজবে খণ্ড-খণ্ড মাংস ছিঁড়ে খাবো — খাস — থুতনিতে সেকেন্ড চিন! পিৎজা-কোক খাওয়া থামা — থুতনির নাম দিই গোলাপজাম — কেন কেন কেন — পরে বলব — এখন দুচোখের নাম দিই — শতনাম হলো না তো — চোখ বোজ চোখ বোজ — তুই তো একশোসমগ্র আবার শতনামের কি দরকার — তাহলে আয় — আজ তুই ওপরে না নিচে?

শিবু কুমার শীল



মিলনাত্মক বিয়োগ


যখন আমাদের মিলন হবে
দুজন দুজনকে ফিরে পাব ভাবছি
তখন ডিরেক্টর তার মত বদলালেন।
তিনি বললেন, ' ছয় নম্বর দৃশ্যে সেটা সম্ভব নয়
আমরা দুজনতো অবাক।
অথছ এই লোকটা গত বর্ষায়
প্রেমিকার ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে
চোখ বুঝে শুধু এ কথাই ভেবেছিলেন যে
ছয় নম্বর দৃশে্য আমাদের মিলন হবে।
উল্টো লোকটি আমাদের ধাঁধাঁয় ফেললেন।
আমাদের দুজনের সামনে রাখলেন সেই পরিমাণ বিষ
যা দিয়ে কেবল একজনের মৃত্যু সম্ভব।

ক্ষ


ক্ষ‘এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম’
আপনি থেমে বললেন।
বললাম বসেন, লাল চা খাবেন?
আপনি বললেন খাওয়া যায়, চিনি কম।
তারপর বহুদিনের না দেখা নিয়ে আলাপ হল আমাদের।
একটা ধুলোপড়া কমরেড আপনার হাতে আমি তুলে দিলাম।
চে, বলিভিয়ার জঙ্গল।
আপনি আর আমি অন্ধকারে বসেছিলাম।
গল্প চলছিল আর আমরা মাপছিলাম
পৃথিবীর উত্তাপ, আর ঘনত্ব।
আমি বললাম স্পর্শ খুব দরকারি জিনিস।
আপনি তাতে সায় দিলেন।
বুঝলাম আপনি স্পর্শ্ব-কাতর।
স্পর্শ্বের নানা গুনাগুন নিয়েও আলাপ হল।
আর আমাদের লাল চা, ধুলো পড়া কমরেড ফুরিয়ে আসছিল।
যেমন ফুরিয়ে আসছিল আলো।
আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে এলাম একটা চৌরাস্তায়।
দেখলাম সারি সারি বাস গাড়ি।
এর মধ্যে হঠাৎ আপনার চোখ আটকালো
একটা মোটরকারের জানালায়
আপনি বললেন দেখেন মেয়েটাকে দেখেন
আমি বললাম অদ্ভুত ঠিক যেন গ্রিক ভাস্কর্য
আপনি একটু থেকে বললেন না না
ঠিক যেন ‘ক্ষ’ নামের মেয়েটার মত।

সাখাওয়াত টিপু



বাসনা বাস না


যদি মরে যাই যাবই বা কেন
পাথরের প্রাণ দেখিতে কে যেন
বাইরে কেবলি মানুষ ছড়াল

কোন শিশু আজ বলে বাঅঅবা
পাথরের মুখে তো ভয়াল থাবা
মন থিকা মন তুমি কি বাসনা

আমাকে নিহত কর হে জানিয়া
মরিয়াছি কোন খোদাকে শুনিয়া
বেহেস্ত নসিব হৌক বিবসনা

তোমাকে ছাড়িয়া রতিভর দেহ
ফেলিয়াছে খাদে অচিন প্রমেহ
আমি কি মাবুদ নালালেক বান্দা

যেই মনে তুমি খেলেও খেল না
সেই ডোরে ঘুমে আমিও বসি না
জাগা ভাল তবে এইতো এষণা

কত দূরে গেলে বসনা চড়ে না
দেখতে দেখতে পাতাও নড়ে না
যাহা চাহ তাহা বাসনা বাস না

মথুরা গায়েন


ছবির আড়ালে তুমি অনেক চঞ্চল
যদি ছবি হও তবে স্থির কেন বল

ছুঁয়ে দেখি সোনা কাঁচের উপরে কাঠ
মায়া সভ্যতার আগে যেন ত্রোস্তপাঠ

আঙুলে যে লেগে আছে সমস্ত ইন্দ্রিয়
নিতে পারো হাত মুখ যতি বায়বীয়

যে জীবন আমার না সেইকি তোমার
দেহ ছেড়ে বের হয় অতীন্দ্রিয় ভার

দুপুর গড়ায় রোজ মহাকাশ ডোরে
ইশারা স্মৃতির তারা রাতমাখা ভোরে

ফলিত মাঠের পর গোপন শরীর
জানু পাতা বোবাতুর মাদুলি বধির

আমি তব বিন্দু সম তুমি যত দূর
বাগে কি ইন্দ্রিয় সহে না করে কসুর

এখন কি গান গায়বে মথুরা গায়েন
স্তনের আড়ালে মুখ ঠোঁটে রাখা ধ্যান

তুহিন দাস



গেল দিনের কাদায় ভাঙা সুর


অরুণ দা মারা গেলেন ২৬ মার্চ ২০১৬। প্রিয় অরুণ সেন। চট্টগ্রামের অরুণ সেন (কলকাতার অরুণ সেন নয়)। কবি অরুণ সেন। ১৬ বছর পূর্বে যখন কবিতার পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলাম তখন যারা আমাকে নিয়মিত লেখা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের মাঝে অরুণ দা'কে মনে করার যথেষ্ট কারণ নিজের কাছে আছে। ২০০৯ ও ২০১০ এর দিকে অনেকবার আড্ডা হয়েছে চেরাগীতে, তার বাসায়ও গেছি দুবার। কথা বলার মাঝে স্নেহটুকু খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয়নি।

২০১৫ সালে বেশ কয়েক মাস চ্ট্টগ্রামে ছিলাম, দেখা হয়নি অরুণ সেনের সঙ্গে বা কারো সঙ্গে। তবে অরুণ দা'কে মনে পড়তো, মনে পড়তো পুরনো স্বজনদের কথা, কবিতার পরীক্ষিত যোদ্ধাদের কথা, কবিতার সঙ্গে যাদের আজন্ম আবাস। মনে পড়তো এ শহরেও তিনিও আছেন, ঘোরাফেরা করেন, এ শহরের হাওয়ায় তার নিশ্বাস মিশে আছে।  সে এক সময় ছিল চিঠিপত্রের দিনের। কত বন্ধুরা রঙবেরঙের খামে ও কাগজে চিঠি লিখে পাঠাতো। কবিতা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে। অরুণ দা’ও লিখতেন দু’কলম, আর তার নতুন নতুন বই। ছন্দে লেখা, মমতা মাখানো, পরিচ্ছন্ন রুচির সেসব বই। আর কবিতা আসতো রঙিন খামে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যেতো। অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন করে পত্রিকার নতুন সংখ্যার প্রস্তুতি নেয়া যেত। এরকম একটি কবিতা পড়া যাক, এবার, কবিতাটি ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার সম্পাদিত ‘আরণ্যক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল—

ইয়ার্কি


হাঁটি হাঁটি পা রাখা পথ কূল সাঁতরাতে চায়
হোঁচট খেয়ে ক’বার পড়ে পথিকে সাঁতরায়

উঠি উঠি রোদ যেখানে ফুটন্ত চোখ তোপে
জলের কোপে ঠাঁই পড়েছে আর কতদূর মাপে

উল্কা লেগে ছাই হলে ঘুম চরকি নাচের মতন
ওপথে ওই চাঁদ ঝুঁকেছে এদিকটাতে পাতন

নিশানাটা ঝুলের সাথে লটকে দেখে নীচে
ঠোঁটের ফাঁকে জিভ বেরুনো রৌরব অতি কাছে

          বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে মাটিতে রোয় ছল
সাহস-পোড়া মই লেগেছে কে নেবে তার ফল

ফল কুড়ানি ঘুম পেয়েছে ঘুমের হাটে যাওয়া
কাজ সেরে নেয় শান্ত হয়ে স্বপ্নে অলীক নাওয়া

ওপথ তুমি এবার বল, নামটা জানি কি?
‘--আর কিছু না, ভালবাসা নামের ইয়ার্কি।‘

কেন জানি এ কবিতাটি আমার ভাল লেগে গিয়েছিল। জীবনের সহজ বোধের প্রকাশ বুঝি আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু তার নিন্দুকও কম ছিল না। তাদের মাঝে মাত্র দু’দিন হল লিখতে আসা সদ্য গোঁফওঠা ছেলেরাও ছিল, আর ছিল তাদের গুরুরা। তারা অরুণ দাকে নিয়ে নানারকম কথা চাউর করে বেড়াতো। তাদের কথা শুনে অরুণ দা সম্পর্কে ভীতি জন্মানোর কথা, কিন্তু মানুষটির সঙ্গে মিশলে অনেক প্রাণবন্ত একটা মানুষ মনে হতো। মানুষের সঙ্গ তিনি ভালোবাসতেন। চিঠি লিখতেন কম। কবিতা পাঠালে তার সঙ্গে কখনো কখনো থাকতো সংক্ষিপ্ততম পরিমিত চিরকুট:’তুহিন লেখা পাঠালাম। ভাল থেকো।‘ ইতি-অরুণ দা।

তিনি শুধু কবি নন, নিজেও একজন সম্পাদকও। ‘ঋতপত্র’ নামে একটি অনিয়মিত পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। যত্ন নিয়ে সারা বাংলাদেশের কবিতা ছাপতেন তিনি। উল্টেপাল্টে-পড়ে দেখতাম তার পত্রিকা, রুচির ছাপ ছিল সে পত্রিকায়। কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য, বেশভূষায় আধুনিক ছিলেন না বলে যারা তাকে চট্টগ্রামে এড়িয়ে চলতো তারা তার কবিতা ছাপার রুচি দিয়ে তাকে কখনো মেপে দেখেনি তারা, মেপে দেখেছিল বহিরাঙ্গ দিয়ে, তার অন্তরাঙ্গে যে এক রসময় আজীবন কবিতামোদী সংস্কৃতবান মানুষ ছিল তাকে তারা বুঝতে চায়নি, ভালবাসেনি। কিন্তু আমরা ভালবেসেছি অরুণ দা’কে। দূর থেকে। কবিকে কখনো কখনো দূর থেকে দেখতে হয়। তাহলে মুগ্ধতা অটুট থাকে। মুগ্ধতা ভেঙে দিয়ে কি লাভ! কিন্তু অরুণ সেন সম্পাদিত ‘ঋতপত্র’ পত্রিকায় কিন্তু কখনও আমার লেখা ছাপা হয়নি। তাতে কি? কখনো আমার লেখা চেয়েছিলেন বলে মনেও পড়ে না। চেয়েছিলেন কি? হতেও পারে। হলেও তাও একবার, কেমন ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে যেন। লেখা নেবার মতো তাগাদা সে ছিল না সে আহ্বানে, সে কারণে বোধহয় কখনোই ‘ঋতপত্র’ পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়নি। তবু অরুণ সেন আমাদের সময়ের প্রিয় সম্পাদকের মধ্যে একজন ছিলেন। তাকে সে স্থানটুকু দিতে আজ আর কোন কার্পণ্য নেই।

সেসব দুপুরবেলার কথা এই চৈত্রের খররোদে মনে পড়ে। মনে পড়ে তার একটি কথা, তুহিন জীবন কি আমাদের এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, তার কথার প্রচ্ছন্নে ছিল আমাদের সমাজ, যাকে তিনি তার প্রজন্মে অবক্ষয়ে ডুবে যেতে দেখেছেন, আমাদের প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তার কবিতায়ও এসে পড়েছিল এ ছায়া, তাই কবিতা ও তার কবিতা পত্রিকাকে ঘিরে তিনি যে সময় ও সমাজসচেতন আন্দোলনের কবিতাযোদ্ধা হিসেবে সময়কে ধরতে চেয়েছিলেন, জানাতে চেয়েছিলেন লড়াই করো, কেননা মানুষ এখন বিপন্ন। যেমন তার একটি কবিতা আছে, নাম:’বোবা কথার ঘর’। সে কবিতায় তিনি একটি শিশুর বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে: শিশুটি সবে একটু আধটু হাঁটা শিখছে, তার কাছে সব কিছু নতুন। আলোবাতাস, দেয়াল, কাঠ, কংক্রীট সব। কিন্তু হঠাত করে কে জানি তার শৈশবটাকে চুরি করে নিয়ে গেল। সে এসে পড়ে থাকলো একমাত্র বই ছাড়া অথর্ব বিষয়গুলোর মাঝে। এ কবিতাটাও আমার এটি প্রিয় কবিতা। আচ্ছা, যেহেতু আমার প্রিয় কবিতা তাই না হয় এটা পড়া যাক—

বোবা কথার ঘর


শিশুটি সবে এক আধটু হাঁটা শিখছে, হাঁটা
আলো বাতাস সব অচেনা।
চেনার পথে হঠাত করে বই
দু’চোখ বেঁধে এক ঠেলাতে
ইচ্ছেগুলো বাধার মুখে বোকা
ভুলের বশে খোরাক হয়ে হাসি
শৈশবটা গিলতে কি যে খুশি
কেউ জানেনি, কৌশোরটা কখন দিল ফাঁসি
একদিন সে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল
কিতাব ছাড়া, সব অজানা, অচেনারাই পাশে

জীবন থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দূর
পেছন ফিরে শুধু দেখছে, গেল দিনের কাদায় ভাঙা সুর

এ কথাগুলো তো আমাদের সবার। সবকিছু রেডিমেড এখন। চেরাগী পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রেডিটিতে চুমুক দিতে দিতে বলছিলেন-’সবকিছু এখন রেডিটি হয়ে যাচ্ছে, প্রস্তুতি নেই কোন। কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। মানুষ হবার জন্যও এখন কোন প্রস্তুতি লাগে না।’সেই অরুণ দা'কে আমার দূর থেকে কয়েকটা বছরের জমানো ভালবাসা। না ফেরার দেশে চিরতরে ভাল থাকুন তিনি। কবিকে যখন আগুন পোড়ায় চমকে যায় আগুনের হাড়।

আশরাফ শিশির



ট্রাজেডি কিং


আমার কোন নির্মাণকাল নেই
আমি আবিষ্কৃত হয়েছিলাম
ঠিকঠাক হয়ে উঠবার আগেই

আমি কতবার ব্যবহৃত হয়ে
তোমাদের বাজারে নতুন করে বিক্রি হতে এলাম
অথবা এতকিছুর পরেও আমার দাম
ঠিক কতটা হতে পারে
সেটা আপেক্ষিক

সাইকেলে ইঞ্জিন লাগালে প্রগতি হয়
আমার স্থবিরতায় তাই তুমি চমকে ওঠো
তাই তুমি ছেড়ে ছেড়ে যাও
আর আমি দুরপাল্লার স্টেশনে
অপেক্ষা করি
অপেক্ষাকৃত সেই যাত্রীটির জন্য
যে অনেক দেরী করে ফেলেছে
তবুও অনুনয় বিনয় করে আমাকে থামিয়ে রেখেছে
তার সহযাত্রীটি আসবে বলে

আমার শরীরে রংচটে গেছে
নাকটা আরো ভোতা
উইপারটা ঠিক আছে, এখনও বেশ কাঁদতে পারি
উইন্ডস্ক্রীণে মাতাল হাওয়া
আমাকে রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী করে দিতে চায়
মনে হয় নজরুলকে নয় আমাকেই ডেকে বলছে,
"দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে
শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে,
তুই প্রস্তুত হ'।"

একটা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে আমি
আমার ভেতরে একটা অ্যাম্বুলেন্স
তার জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া আলোটা
কেউ দেখতে পাচ্ছে না...

রাসেল রায়হান



আদ্যন্ত


আদিতে নেই অন্তিমে নেই আমার পাশে কেউ দাঁড়াবার;
দরকারও নেই, থাকুক এসব অসঙ্গতি, অসম্প্রীতি।
কী যায় আসে?

আমিই জানি মশলাভর্তি নৌকা ডুবলে আমার বাবার
খাটের পাশেই হুড়মুড়িয়ে পড়ছিল যেই কাঁদার স্মৃতি,
এখন তারা আমার পাশে!

আমিই জানি সন্ধ্যেবেলায় যে-পথ বাড়ির দিকে যাবার,
বুকের মধ্যে আমায় এবং হাঁসের বাচ্চা এবং ভীতি
নিয়ে সে-পথ আমারই মা কোন উপায়ে মাড়িয়ে আসে!
কী যায় আসে!

আত্মরতি


তোমার যে তির
          লেগেছে
তোমারই ঘোড়ার গায়ে,
তাকেই
   ধনুকে জুড়ছ
কিসের অভিপ্রায়ে;
ঘোড়াকে
যতই বলছ
    এটা তার নিয়তি,
সত্যি হলো একেই বলে
          আত্মরতি।

মাতাল


‘কে চেনো আমায়, আমার বাসায় কে নিয়ে যাবে’—এই দৈব এবং বিষণ্ন কৌতুকটি আমি শুনেছি শুঁড়িখানার সামনে। আলোয়ান জড়ানো সহিস একটি আনতমস্তক ঘোড়ার গাড়িসমেত এসে দাঁড়াল। ইতোমধ্যেই আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম ডানা ও ডমরু। আমার বন্ধুরা ভিড়ের মধ্যে আমায় তুলে অনবরত ছুড়ে মারত—শূন্যের আনন্দ দিতে, তারাই বাজাত করতালি। সেইসব বন্ধুরা একদিন ভাড়া করে এনেছিল মোমের মুদ্রায় নেচে ওঠা পর্তুগিজ নর্তকী—নাচ শেষে যে আমায় প্রেমপত্র লিখেছিল তার ভাষায়। সে-চিঠির মর্মোদ্ধার করতে অনন্তকাল ঘুরে বেড়াচ্ছি ভাষা ইন্সটিট্যুটে...
শুঁড়িখানার সামনে তখন আমার ডানহাতে পর্তুগিজ বর্ণমালা;— বাঁহাতে আমি ইশারা করছি সহিসকে, মাতালকে...শুনতে পাচ্ছি, প্রগাঢ় বিষণ্ন কোনো করোটি হাসছে কোথাও—যে ভঙ্গিতে আমি এতদিন হেসেছি।

দঈত আন্‌নাহল



নেশাতুর প্রেমে!


আমারতো নেশা কাটে নারে সাঁই;
কি নেশাগো, নেশা খুউউব কাটে!

কতও কি যে ঘটে, বিষ্টি হয়, বাজ পরে;
মানুষ কান্দে ও কান্দায়, তবু আমারতো
নেশা কাটে নারে সাঁই;
নেশায় খালি কাটে...

নেশাতুর আমি, কাটা পরতে থাকি।

ব্যাথা!


বুকের ব্যাথা নিয়ে আমরা
কোনো কথা বলবো না; আচ্ছা?
আমরা ঘুম নিয়ে কথা বলতে পারি। অথবা
দূরত্ব; অথবা, পৃথিবীর সুন্দরতম দেশগুলি;
যেসব শহরে তুমি একা যাও; আমার হয় না;
তারচে বরং এসো আমরা
আগুন নিয়ে কথা বলি; আচ্ছা?
ছাই নিয়ে কি কথা থাকে কারো! ছাইকে
কেবল বেসেছে ভালো হাওয়া, আর কে!
এই য্যামন আমি;
তোমাকে;
তোমাকে;
তোমাকে।

মৃত্যুগ্রস্থ!


আমরা মৃত্যুতে অভ্যস্ত।
কেবল মৃত্যুর স্থায়িত্বকেই ঈর্ষা করতে পারে মানুষ।
অনুপস্থিতির শুন্যতার বিষও ক্রমশ: মাদকের মত
গ্রাস করে শিরা উপশিরা।
জীবনের অধিক মৃত্যুকেই ভালোবাসা যায়, সে প্রেম;
ডিক্টেটর, বেদনার মত মাতাল করতে করতে সে নেয়
সমগ্র জীবন; মৃত্যুগ্রস্থ!

আরণ্যক টিটো



উদ্‌যাপনের পদাবলী


একটু পিছাতে চাই / পরান কথার নীড়ে / …
গতির লালিত্যে /
ধনুক /
যে ভাবে বেঁকে যায় পিছনের দিকে /
কৃষ্ণকালা জানে /
পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রে /
অর্জুনের /
পশ্চাদগমনে লুকায়িত ছিলো / মহাবীর / কর্ণবধ / …
একটু পিছাতে চাই /
অন্ত্যজ মাটির কাঁচাসোনায় / জেনে নিতে কর্ণের বেদনা / …
টা ন টা ন /
ধনুকের ছিলাময় /
বুড়ো আঙুলের ইতিহাসে /
মর্মের পোড়নে জেগে ওঠে একলব্যবিশ্ব /
প্রাসাদের ভারবহ /
ক্ষমতা কেন্দ্রের খুঁটি / মধ্যবিন্দু ছেড়ে /
নতুন সৌন্দর্যে সরে যায় / প্রান্তরের দিকে /
একটু পিছাতে চাই / পরান কথার নীড়ে /
খনার /
কর্তিত জিহ্বা জানে /
কথার মালায় রচা / বিনিসুতো মালা / নিবিড় বন্ধনে বাঁধে /
উদ্‌যাপনের পদাবলী / …


ধূলোবালিসংসার


পাখি, যাবে নাকি ওড়ে?
সায়ঙ নদীর তীরে,
রোদেলা সুখের ওমে,
   পথের বেদনা ভুলে,
                     বসব,
                     সজনে গাছের ডালে।
মৃদু তরঙ্গে বহেনা  
      স্নিগ্ধ শোধন সলিল,
বুড়িগঙ্গা তীরে নামে
      নিশিথিনী অন্ধকার।
          চল যাই ভেসে ভেসে
দূর সুদূরের নীড়ে,
     কাঁদুক পিঞ্জিরা
                    কাঞ্চন বাঁশের দেহ।
ও'পাড়ে হাসে জলকনা
       সপ্তপদী প্রেম,
সবুজ ঘাসের দেশে       
       শিশির কণিকা।

       কীর্তনিয়া তীরে
নিগূঢ় তিয়াসে যদি চাস দেবো
                    ঠোঁটে ঠোঁটে কবোষ্ণ আদর।
            দীঘল পথের পরে
                    ধূলোবালিসংসার।…


ফেরদৌস নাহার



প্রতিবিম্বের অনুবাদ


সেই রেললাইন বারবার সেই জলের কাছে, আমার সব মনে আছে
বিকেলের শান্তনীল চোখ জলে ফেলে বসে আছে আকাশ
কেউ একজন হেঁটে আসবে বলে তুমি দৌড়ে গিয়েছিলে
রেললাইন ধরে। আকুল ওলটপালট হয়তো একেই বলে
সে বসন্তে লালজামা গায়ে সবুজ গাছেদের দিকে তাকিয়ে
আন্দামানে উড়ে যাওয়া নির্বাসিত পাখিগুলো বলেছিল-
সব ফাঁকি! জলের ছায়া হাসে, হাসতে হাসতে মায়া বাড়ে
মায়া থেকে উঠে দাঁড়ায় অজানা নৈঃশব্দ্য, ভেসে আসে হুইসিল
প্রতিবিম্বের অনুবাদ বারবার বলে, দেখে নাও আরো একবার
নির্জন ওয়েটিং রুমে কিছু ফেলে গেলে কিনা

সানগ্লাস খুলে বলো


বারবার যেতে চাই পুরোপুরি তোমার কাছে
কোনো অর্ধেক নয়, কোনো অংশত নয়, সম্পর্ণ তোমার কাছে
এই তুমিটা কে? বাজারি সানগ্লাস পরা একজন অজানা আগন্তুক
যাকে মনে করছি খুব চিনি, আসলে ষোল আনাই কি ফাঁকি
ফাঁকি দেয়া এক একটি মানচিত্রে যে যে প্রণয় ছবি আঁকা
শুন-শান ঝিম-ঝিম সেইসব সম্পর্ক কিছু তার মানে রাখে না
বারবার বারান্দায় এসে বলছে- দরজাটা খোলা রেখে গিয়েছ বলে
কালরাতে সম্পূর্ণ চুরি গেছে আপন সঞ্চয়ের সরল মাপকাঠি, শুধু
নেয়া হয়নি সেই অগ্নিপাত, যে তোমার বুকের ভেতরে করে বসবাস
আহা কী দুঃসাহস!
সানগ্লাস খুলে তুমি এই কথাটাই আরেকবার বল তো দেখি

ক্রসফায়ার


অপূর্ব এই ঝরে যাওয়া
বাতাসের সাথে সাথে তাল রেখে চল, নয় ঝরে যাও
যারা চোখ ও মনের শ্রুশ্রূষা জানে বলে মনে হয়েছিল
তাদের বুকে মরুভূমি খরাচর ঘন অন্ধকার
এসব জানতে গিয়ে নিজের গায়েও লেগেছে ধুলো
বিষপিঁপড়ের কামড়ে চুলকাতে চুলকাতে রক্তাক্ত
তবুতো জানা হল
ঈর্ষা ও করুণাই আজ ভালোবাসা। এইসব অভিনয়
ঝুঁকে ঝুঁকে কুয়ো জলে দেখে নেয় লুকানো স্বরূপ
জলাতঙ্ক রোগে ভুগেও সারাবেলা তৃষ্ণার চাপকল চাপা

মুজিব ইরম


চম্পুকাব্য


সে বড়ো দেমাগী হয়, আর আমাদের বিদ্যালয়ের দিনগুলো বিরহী হয়ে ওঠে। ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সম কোণের সমান—এই সব জ্যামিতিক মারপ্যাঁচ অসহ্য ঠেকে। আমরা ভুল করি আর লাস্ট বেঞ্চে বেদনা ঝরাই।

তার চিপচিপে দেহ বাতাসে দোলে, তার বাঁকা চোখের কটাক্ষ আমাদেরকে ধরাশায়ী করে। আমরা তার মন পেতে চাই, আমরা তার দয়া পেতে চাই।

এ এক এমনি সময়, কারো দেমাগ, কারো বা হাসি, কারো চলার ভঙ্গি, কারো বা চোখ, দেহের গড়ন আমাদেরকে কাতর করে। আমরা রাত জেগে মন ভিজাই, বেদনা বাড়াই।

আর একে একে এইসব হাসি, এইসব দেমাগী চলন, দেহের গড়ন আমাদেরকে বেফানা করে জীবন থেকে নাই হতে থাকে। লন্ডনীরা সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে নিয়ে যায়, আর আমাদের হৃদয় ঝাঁঝরা হতে থাকে।

আমরা শুধু বড় বড় পাশ দিই, আর দিনে দিনে সুন্দর হারাই!


শীত নামে আর বিকাল বেলার চারা বিছরা আমাদের মন টানে। আমরাও দল বেঁধে হরতন-রুইতনের প্রেমে পড়তে চাই। পুবের বিলে রাত জেগে শুনতে চাই মালজোড়া, পীরমুর্শিদী গান। এতোসব আমরা পারি না। গার্জিয়ানদের কড়া নজর আমাদেরকে কান ধরে পড়ার টেবিলে বসায়। আমরা ‘যে জন দিবসে মনের হরষে’ জপতে জপতে গলায় রক্ত তুলি।

কিন্তু এতাসব সুজা ভাই পারে। আর পারে বলেই সে হিরো হয়। দক্ষিণ পাড়ার কমলা আপার প্রেমে পড়ে, কিন্তু সফল হয় কি না আমরা তা বুঝতে পারি না। আমরা দেখি কমলা আপার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেলে গাঞ্জা খেয়ে সুজা ভাই পাড়ার টং দোকানে হৈ চৈ করে, আর ঝিম মেরে থাকে।

একদা আমরা বিদ্যালয়ে যেতে এও দেখতে পাই আমাদের হিরো সুজা ভাই চৌরাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোলে ব্যস্ত। জগতের এত এত যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ তার আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকলে দিন শেষে আমাদের সুজা ভাই গ্রামে ফিরে রাত পাহারায় নিয়োজিত হয়। আমরা তখনও সুর করে পড়তে থাকি—কাঁটা হেরি ক্লান্ত কেনো কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?

অরবিন্দ চক্রবর্তী

মুখোশনাচ


রঙের ব্যবহার ছড়িয়ে ছায়া নাচ করে
আমি ছোবল থেকে মুক্তি চাই...

দৃশ্য দেখি, স্রোতে ভেসে যায় কারো মায়া— মাথার মুকুট
খসে পরে তোমার সকল মহিমা, মুখোশ।

স্ট্যাচুর মাথায় টোপরপরানো সূর্যোদয়,
তোমাকে বলা যায়— আমি আহ্লাদিত, স্বপ্নদুষ্ট নই
এবার যে কোনো শাড়িহিন রাত্রিকে কোলবালিশের পাশে শুয়ে যেতে বলা যায়।

কিছু ঘুমপোকা ছিপি খুলে ভূতুম-পায়ে এগিয়ে এসে
আমাকে ব্র্যান্ডি ওয়াইনে বুদ হতে নির্দেশ করে...

সবুজ অক্সিজেন সরবরাহকারি এক সনাতন নাচুনেকে তখনো দেখি
গোপন প্রমিজ ডোবানো ফোয়ারাতলে
বেঁচে থাকার বাসনায় রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে স্নানঘরের অন্যান্য মুদ্রামগ্নতায়।


সাহস


তাস খেলা বাদ দিয়ে যারা যুদ্ধ করেন
জনৈক দার্শনিক তাদের পরামর্শ দিলেন,
‘আস্ত জীবন নিয়ে বাঁচতে চাইলে
জুয়া খেল, জুয়া খেললে আয়ু বেড়ে যায়।’

পরমাত্মাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে লাগাম দিলাম ছেড়ে
মজা হল বেশ, বাতাসকে দিলাম প্রাণ
জীবনের সাহস দেখে ঘোড়াতো আমার ছুট।

আরবের ঘোড়া এসে চম্পট—  দেখা দেয় এশিয়ায়
আস্তাবলে কেউ থাকে না
থাকে শুধু হরতনের উল্লাস ও আফিমখোরের হাপিত্যেস।


জীবন


ভঙ্গি করে তাকিয়ে আছে জীবন। জীবনের ওপরে আকাশ বহিয়া যায়...

ছাদের নিচে যে কটা প্রাণ বসত করে, সিঁড়ি মাড়াবার জ্বালায়
তোমাকে ভালোবাসবে বলে তারাই তীর-ধনুকের আয়োজন করে।

ছুটে আসে হাওয়া। ওদিকে সংবাদ রটে যায়, আমি চাঁদের নিচে ঘোড়া দাবড়াই।
সংগত এগিয়ে আসে কার্নিশ, ঝুলে পড়ে আমাদের নিয়তির যত উপমা।

তখন বোঝা যায়, মৃত্যু বিষয়ক যতসব অকথ্য ব্যাপার
পৃথিবী বাইরের গোপনে থাকে- থাকতেই পারে।

তবে সকলেই জানেন, আকাশ নামটা রাষ্ট্রের কাঁটাতারকেও মিথিক্যালি নিকুচি করে।

আলী আফজাল খান



নাচনী এবং নাটুয়া


অপভ্রংশ:

    ধামসা বাজে দ্রিম দ্রিম
    মহুয়ার গন্ধে ঝুমুরের উদ্দাম
    নড়েচড়ে উঠে লাভা প্রতিমা
    পরাগের রেণু, চোখ, ভস্মময় মাটি
    নাড়ি, খুলি, হাড়, এই ফুসফুস, রক্তনালী
    খিলানে জমা দীর্ঘশ্বাসের ধূলি
    মালশায় আগুন আর ঘি

সংকর ধাতু:

    ডানায় লাগছে জোয়ার
    লোহিতকণিকায় উড়ন্ত ঈগল
    চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঠোট আর নাকের কোটরে
    মৃগনাভির গন্ধে মাতোয়ারা
    জ্বলছে জোনাকি বসন্ত সহবাসে
    স্নায়ুর ঝিল্লি আঠালো প্রেমের কুসুমে
    মূর্ছনায় ময়ূরের নাচ
    বালুচরী কারুকাজ
    রৌদ্রের সুরমা
    শিয়রের যতিচিহ্ন ছিঁড়ে স্বপ্ন সঞ্চারণ
    লকগেট খুলে পাখনার উড়ান
    মরুর বালিয়াড়ী কুঠুরী ষড়ঋতুর শান্তিনিকেতন
    জীবনের খনিজই তাই দিয়েছে টান

যুগলবন্দি:

    টানা স্লেটে কষ্টে পোড়া কয়লায় লিখি
    যুগলবন্দির ‘অ আ’
    অ-তে অধরা
    আ-তে আকাশ
    আর দেখো উঠানে হাজার হাজার জালালী কবুতর
    উষ্ণতা তো তোমার হৃদয়ের মধ্যমা বরাবর
   
[নাচনী: নাচনী নাচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা, উড়িষ্যা ও  ঝাড়খণ্ডে প্রচলিত এক লোকনৃত্য বিশেষ। নাচনী নাচ ঝুমুর গানের সঙ্গে পরিচালিত  হয়ে থাকে। এই নৃত্যে সুস্পষ্ট মুদ্রার ব্যবহার না থাকলেও হস্তক, চারী,  ভ্রমরী প্রভৃতি ঠাটের লক্ষণ রয়েছে। আসরে উপস্থিত রাধা ও কৃষ্ণের যুগল  মূর্তিকে প্রণাম করে আসর বন্দনার মাধ্যমে নাচ শুরু হয়। নাচনী নাচের  গানগুলির প্রধান রস শৃঙ্গার এবং রাধা কৃষ্ণ লীলা মূল বিষয়বস্তু। একটি তিন  ফুট উচ্চয়াত্র পনেরো থেকে পঁচিশ ফুট ব্যাসার্ধের এক গোলাকৃতি বেদীতে  নর্তকীরা নাচ করে থাকেন। এই নৃত্যে ঢোল, মাদল, সানাই, শিঙ্গা, কারহা,  কেড়কেড়ি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নাচের দল সাহারণতঃ পাঁচ  থেকে কুড়ি জন নিয়ে গঠিত হয়। দলের প্রধান পুরুষকে বলা হয় রসিক বা রসক্যা  এবং নর্তকীদের বলা হয় নাচনী। নাটুয়া: নাটুয়া নাচ বা নাটা নাচ বা  লাটা নাচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় প্রচলিত এক লোকনৃত্য  বিশেষ। সাধারণতঃ বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত এই নাচের আসর বসে। নাটুয়া  নাচ পৌরুষ দৃপ্ত নৃত্য বিশেষ। এই নাচের মূল লক্ষ্য দৈহিক শক্তির প্রদর্শন।  সুদৃঢ় বলিষ্ঠ পদসঞ্চার ও অঙ্গবিক্ষেপের মাধ্যমে ঢাল ও তরোয়াল দিয়ে  আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে খেলা প্রদর্শন এই নাচের বৈশিষ্ট্য। এই  নাচে দেহ সুগঠিত ও বলিষ্ঠ হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়।]

অনন্ত সুজন

রতিপুষ্প


ছায়া বিনিময় হয় নির্জন নিধুবনে—তাই
রাত্রির ক্যামেরা দৃশ্য শিকারে দক্ষ জাদুকর
অবশ্য নিবিড় রোমন্থন অনুরূপ ভ্রমণের
পুলক সঞ্চার ও প্রদানে প্রায় সমান উপভোগ্য!
আবার কখনো, ধারনার অনেক উঁচুতে
পৌঁছে গেলে মেঘের অন্তরালে নিখোঁজ হওয়া
বিমানের উদাহরণ তাসের আসর জমায়।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল ঘুরে এসে দেখি—
স্থলের উপরিভাগে উড়ছে নিষিদ্ধ নিশান!
অবদমনের অস্ফুট আর্তিতে ব্যাকুল বিরহবাতাস
ঘামের সমুদ্রে ভাসে পারফিউমভর্তি জাহাজ!

ঘড়ি


যে আমায় রাত-জাগা শেখালো, সে'ই বলে—
চলো, ঘুমাতে যাই! এই গান গুঞ্জরিত হলে,
নড়ে ওঠে গ্রহের কাঠামো, অদেখা ওই পল্লবিত
ঘ্রাণের বাগান। সে এক মুহূর্ত বটে, অর্বুদপ্রেমে
চূর্ণ মুখশ্রীমদিরা, নেশা ঝলমল বদ্বীপে লণ্ঠনের
জাদুকর! আহা, পরাভূত জ্যোৎস্নার হাড়
কী ভীষণ গলে যায় শুধু!

হাসান রোবায়েত


মুখ


এখানে জলের পরে জল
শুয়ে আছে মনোভাব হয়ে
অপ্রতীম বেদনার দিকে
অনায়াসে ধীর পরাজয়ে
যদি তার ঢেউগুলি টানে
মুখের মানুষ থেকে বেশি
বলো তবে ভাঙা আবহাওয়া
টারবাইনের প্রতিবেশী।
নিজের শরীরটুকু ছুঁয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছি কতদিন
এই রাত অনন্ত আর্মার !
বাতাসে ভাসছে মরফিন।
আমার ব্যাধির পাশে লুপ
ঘুরে ঘুরে সহস্র বিলাপ
মানুষ: একাকী বয়ে যাই
আজীবন-গাঁথা এপিটাফ—

সূর্যগ্রহণ


তবু বালির দিকেই উড়ে যায় আমাদের সমুদ্রসন্তাপ
আনে চৈত্রপতনের হাওয়া
আসন্ন ইটের ছায়ায় যারা নখ কাটে
অনন্তর ফলগুলি রুয়ে দেয় রঙের স্বভাব

যদি কুম্ভ রাশির দিকে হেলে পড়ে তারা
তবে হে ফলন্ত এনামেল, একটি দেখার উপর
থেমে যাবে রেটিনার ছায়া
তখন ট্রিগারও বাক্সময়, পিস্টনে পারাবত নিয়ে
সূর্যগ্রহণের দিকে
আছে আভূমি তাকিয়ে থাকা—

যাত্রীছাউনি


ছিল কারমেল আশ্চর্য বগলের নিচে
—হালকা লোমের
ক্রমশ ব্রিজ থেকে উড়ে আসা জুঁই
তুমিও পেতে পারো ভাঙা হারিকেন
যেরূপ ঘোড়ার কেশর উঁচু মাধবীর দিকে
বাড়ায় ডিলেমা—

হয়ত ফুল চর্বির থেকেও বেশি পরশ্রীকাতর
অথচ দুপুর—
শিশুরা যাত্রীছাউনি ভেবে জড় করে পীঠ
নিঃশব্দ সিনেমার দিন
আধুলির সমান রোদে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে!

বসন্ত বোস



১.

বস্তির বিকেলগুলো
ঝগড়া করতে করতে
শহর দখল ক'রে নিচ্ছে

মাও সেতুং, ফিরে এসো
আমরা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে
হাওর ভেবে ব'সে আছি

কম স্টপেজ সার্ভিসে
কবুতর কুড়ানো
ভালো না, জেনে যাওয়া ভালো না

৩.

ক্ষুধার্ত পথশিশুর মতোন
অথবা
বেহায়া রাজনীতিবিদের মতোন

তোমাকে চাইছি, মেঘ, শহরে
মানুষের মতোন
মানুষ না পেয়ে
মড়কের অভিপ্রায় সেন্ট পলের দরোজায়
পৌঁছে দেবার আগ মুহুর্তে, মাহুত
তোমায় চাইছি, মেয়ে

উদ্যত সাতান্ন ধারার
ফণাতোলা
মড়া ও প্রেতের আছরের মতোন, এই
আছরের ওয়াক্তে, মহাপ্রলয়ের
আসন্ন ক্ষণে
তোমায় চাইছি, যেভাবে
জুমিয়া মেয়ে
মিকাঈল ও নাজিম হিকমতকে চায়
একসুরে...
৫.

আম্মার সাথে আমার যে ছবিগুলো সংগ্রহে আছে, সেগুলা, অনলাইন হ'তে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এনালগ দুনিয়ায় কোনো নদীর জলে, ভাটির টানে, আম্মা, তিতাসের শালুকপোড়া বিকেলের মতোন আমাকে বিবশ ও অবশ করে রেখেছেন। আমি কোথাও যাইতে পারলাম না। আম্মার কাছেও না।

হাসসান আতিক


খুতবা


বৃষ্টি হয়ে বেলাদাতের পর যখন আপনি
গুয়ের ওপর গিয়ে পড়লেন
আপনার আর কোনো মর্ম রইলো না।
শীতলতা, ঝুমঝুম শব্দ কিংবা জলের
সুভ্র কারুকাজ─
আপনার কাছে প্রত্যাশা করবে না কেউ।
অতএব হে ‘পরহেজগার’ বৃষ্টি সমুদয়
আপনারা যারা নিজেদের আসমানি ভাবেন,
পাকসাফ জানেন; আপনাদের

থামার প্রয়োজন আছে।
ফিকিরের জরুরত আছে।

রাষ্ট্র, তুমিও তো বৃষ্টি।
তোমার পেটের ভেতর কতো রকম মাখলুক
তারা সিঞ্চিত হওয়ার আশায়, একটু ঠাণ্ডা হয়ে
ঘুমানোর খাবে─ জুবুজুবু চোখের এন্তেজার
দীর্ঘ করছে। ছেলেদের শিরদাড়া বেঁকে যাচ্ছে,
খসে পড়ছে মেয়েদের কাজল।

অথচ তোমার
সাড়া নাই; সাড়া নাই।

তবে কি তুমি হিন্দি গান শুনতে শুনতে
বেখেয়ালে গুয়ে পড়ে গেলে?
তোমার ইহলৌকিক জাতীয় সংগীত,
রঙিন পতাকা আর নিজস্ব ফসলের ঘ্রাণ─
কিছুই কি টানে না তোমায়?  
স্বাধীন মেঘ ফেলে একটা খবিশ দুর্গন্ধ নিয়ে
তুমি উড়ে বেড়াচ্ছ। আর ভাবছো─
কারো নাক নেই।

শোন,
আমাদের নাক আছে
আমাদের চোখ আছে
এমনকি দুটো হাতও আছে
আছে হাড়ের দশটি আঙ্গুল।

হে রাষ্ট্র, সহি হও। এখনও চে’র মুখ বুকে বুকে ঘুরে।

হাসান মসফিক


পদ্মরাগ


অনেক জ্বরের ভেতর, কারা সেঁটে দিয়েছে উষ্ণতর বেদনা। খুলে পড়ে যেতে বসেছে অন্ধকার, গহ্বরের ফিতে আরক্তিম শিশির কিছুটা উন্মুল বাসনা।
বাতাসের বনে আমিই কি কেবল শূন্য হাতে এসেছি! এতো প্রেম নিয়ে চাঁদের মতো নিঃসঙ্গ আর কাউকে তো দেখিনি
এমন দগ্ধভাগ্য, উপযুক্ত আঁধারেও জ্বলে জ্বলে উঠছে ফুলেল রেণু! সুললিত মুখোশ চাপিয়ে আমরাও প্রতিদিন ফেরি করে চলেছি বন্ধুত্বের কফিন

শরীফ খিয়াম আহমেদ ঈয়ন



গাধার গয়না


স্মরণে কৈবর্ত বিদ্রোহ

নিশ্চিত অনার্য আমি আদি কৈবর্তের ছেলে
সহস্র জনমে ছিলেম - মিঠে জলের জেলে
বার বার ফিরেছি বঙগে, ফিরিয়েছে মোহ
- মননে অনিবার্য আজও বরেন্দ্রী বিদ্রোহ।

অহিঙস ধর্মের নামে ক্ষিপ্ত সহিঙসতা-
রুখেছিলো যে কৌশলে এই নদীমাতৃকতা
যুগ-যুগান্তর ধরে যাচ্ছিলাম লিখে তারে
সেই অপরাধেই খুন হয়েছি বারে বারে।

গায়ের রঙটা কালো, গাই স্রোতস্বিনী সুরে
মোর রক্তে কত প্রাণ জানে পাল অন্তুপুরে।

মনে পরে সেবার - ছিলেম গঙ্গার উত্তরে
স্বর্ণকলসে বশীভূত লোভাতুর স্বীয়জাত
কী জলদি মিলিয়ে রামপালের হাতে হাত
প্রকাশ্যেই মদদ দিয়েছে আমার হত্যারে।

আরো কতবার মরেছি স্বজাতি সূত্রে ইস!
কখনো পলাশী, কখনো বা ধানমণ্ডি বত্রিশ
তবু ফিরেছি ফের কূটরুধির করতে হিম
আমি দিব্য, আমিই সেই রুদোকপুত্র ভীম।


শবে-ব-রাত

সওয়াবী নেশায়
যে ইবাদতী হায়
কওমী ব্যবসায়
বেঁচতে চায় সব
নারী তেল আরব
কোরান সুন্নাহ রব
- সে’ও মুসলমান
বলছে যে জবান
হে আল্লাহ মহান
বলবে কি তাদের
ওরা আজ কাদের
আর কারা কাফের

যাদের ধর্মপতি
এবঙ মতিগতি
চেনে না ভাবরতি

- জানেও নাই তারা
কোন প্রেমেতে কারা
অসীমে আত্মহারা
দুনিয়াবী ফিকির-
স্বর্গলোভী জিগির
এড়িয়ে ধীর স্থির
কে সে ঈমানদার
মাওলার দিদার
চেয়েছে শুধু আর
কার জায়নামায
বোরাক রূপে আজ
করতেছে মিরাজ

দুখাই রাজ



যোগ্যতা


শেষবার কথা হলো পাহাড়ের কিনারায়
চাইলেই ঝাপ দিতে পারতো
তার ডানা ছিলো কার্পাসের

তিনদিন কেঁদেছিলো— উচ্চতার ভয়ে
ডানাগুলো কেন ছিলো?

আমাদের ঘুমের গেলাস


শেষতক আমরা ঘুমিয়ে যাই। অনড় ঘুম। আমাদের পিনপতন শব্দ নড়ে ওঠে- আমরা ঘুমিয়ে আছি। আমাদের গভীর অসাড় ঘুম।
ডাক্তার কেটে নেবেন বলেছেন কিছুটা। আমরা পড়ে আছি। অপারেশনের কাঁচি ছুরি কচ কচ শব্দে নাচছে, আমরা প্রতিবাদি হয়ে উঠি। আমাদের পিনশব্দ জেগে ওঠে। হুংকার করে।
নিয়ত আমরা চোখ গলিয়ে এসেছি বিছানায়। একটা শক্ত বালিশ। একটা ছারপোকা কামড়ে ফুলেছে। খড়ের গাদায় ছারপোকা! বিস্মিত চোখে দেখি। বৃষ্টিতে ঘাসে জোঁক ছিল। টনকে টনক ঠুনকাঠুনকি করে। কি ছিল? তা ভাবার সমাপ্তির আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি আমরা।
চোষণ ক্ষতে ভিটামিন কে' চুষে খেয়ে যায় জোঁক। নাম জানা নেই। আমাদের জ্ঞান অতোটা বিস্তার পায়নি নেশার ঘুমে। মারিজুয়ানা ঘুমে। চরস ঘুমে। হাত বাঁকা করে গেলাসে ঢালতে শিখে যাই আহা মদ! ঘুমের ভেতর। শেষতক আমরা ঘুমিয়ে যাই। নিশার ঘুম। অসাড় অনড় ঘুম।

সঞ্জয় ঘোষ


রেইনিজম


১.
হে বৃষ্টিবন্দী দীর্ঘায়িত সকাল...
তোমায় মনে থাকবে
আর ভিজে যাওয়া দুপুর
তোমার জন্য উষ্ণতা লেখা থাক
পকেটের ভাজ করা সুখে

২.
আমার বৃষ্টিগাড়ি
তোমার মেঘমালতি মন
তবু ভীড়ে ভীড়ে
হারাচ্ছে জীবন

৩.
আমাদের সবকিছু শেষ
তবু বৃষ্টি এলে মনে হয়
পৃথিবীর এইমাত্র শুরু

আরোপিত অন্ধকার


ভেবো না পিতারাও পাপি ছিলো
ধানক্ষেত মন মাপো কোন আরশিতে
বিভেদ বিষম লাগে লাগুক তোমার
কারো তাতে হয়ে যায় শকুন-বিজয়
ইতিহাস ঘুমিয়ে গেলে—
এইখানে কুকুর-মানচিত্র জেগে ওঠে
গুজে দেয়া অন্ধকারের নিচে
নিভৃত ভ্রমনে পোড়ে আমাদের ষড়ং জীবন
চলো মৃত্যুর কাছ থেকে ঘুরে আসি ঢোলের কাঠিতে
রক্তমাতাল নাচ হবে এই বৈশাখে।

জাহিদ মিল্টন



কলাবাগান মানে এক একটা ব্যর্থ গল্প। এই রকম আরো আছে। যা ভুলে যাচ্ছি তা হল, আমি দেখেও বলি না রোজ সন্ধায় একদল মানুষ রাধা-কৃ্ষ্ণের বন্দনা করে। মন্দিরের ঘন্টাটা আজও মিসিং। ঘড়িটাও তার ভাল না। মাছেরা গায় গান, নট ভিজুয়াল। তাল ধরে নেয় গলে গলে যাও না কেন বেদনা মোর! গলে যাও, তুমিও ভোর। একটা একটা করে মোট ৫টা মৃতদেহের ভার ঘাসের কাঁধে। আমার কান্না পায় খুব। আমিও ভাবি ঘাস হয়ে যাই। হাসিও পায় খুব। ঘাসেদের হাসি কেমন হবে?

আমাদের মদ খাওয়ার চাহিদা তেলাপোকার মত নিবিঢ়। আজ সুমনার গায়ে হলুদ। হলুদ রং'র সাথে আমার ঘুমুতে খুব ভয় হয়। এদের সাথে শেষবার দেখা হয়েছিলো লাশকাটা সজ্জিত টেবিলে। আমাদের মনোযোগ ছিলো পরস্পরের দিকে খুব। আমাদের সুযোগ হয়েছিলো মুখ ফসকে কতদূর যাইবো তার অশ্লীল বিবরণকে টকটকে লাল কিংবা সবুজ পর্দা দিয়ে ঢাকতে। একদিন দুপুরেই জারুল ফুল গুলো ঝড়ে পড়ে গেল। একদিন বরফকে দেখেছিলাম গলে যেতে একেবারে। স্বপ্ন ছিল, রাত ছিল, পাখির বাসা ছিল, বাসায় তুতুতা ঘুমুচ্ছে। আমাকে মনে হয় আজ প্রচুর মদের সন্ধানে যাইতে হবে। পিঠের ওপর পাহাড়। তা কেন আস্তে গলবে না।

ছুটির দিনে রোদের আকাশ মূলত একটি ছাতা। ছাতার তলেই আমার হাঁটা। এই যে রোদে হেলান দেয়া দু মুঠো বাড়ি গুলো দাঁড়িয়ে। পলাশ পাড়ে আগে এরা অঙ্ক শিখতো। তখনই তাদের কাঁদতে দেখেছি প্রথম। এরা আজ মুক্ত। ওপেন লাইব্রেরী। একটা জারুলতম রোদ আয় না ফের। বস্তুত পক্ষে আমার দেখার আছে অনেক। আমি এইরম সকাল চাই-এইরম দুপুরও চাই- চাই বহুমুখী বইয়া যাওয়া গন্ধ বাগানের সন্ধ্যা। খুব একলা চাই। হাঙর দেখেছো জারুল? দেখা হলে আমি চা’ও খাওয়াই।

পরস্পর পরস্পরের টানা বৃত্তের বাইরে। বৃত্তের বাইরে ভোরবেলাও। আমার বুক ফুটো হয়ে গেছে। মাঝপথ ভিজিয়ে এখন পা অব্দি লাল। গন্তব্য সমানসমান, শুন্য। আমরা রাতের পথ হাঁটলাম। হাওয়ার সাথে শিশু পলিথিনের খেলা। আমরাও খেলায় অংশ নেই। কিন্তু আমরা কে? হাওয়া কি ঐ পলকা সাদা পাখা ওয়ালা জড়ো বস্তুর বন্ধু? নাকি পিতা? কিন্তু রাত ঐদিকে পলাতক, আমাদের দিকে মনযোগ; ইদানিং সেচ্ছায় দিচ্ছে না কোন ফেরীওয়ালা। শহরের এক বিরিয়ানী ঘরে রেলগাড়ি চলছে সেই। আর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্বলছিল আসমানী আলো।

আজকে আমাদের দুইটি ফুল। রাত বিছিয়ে খড়ের উঠোন। আসমানে লেগে গেছে সাতকথা। বৈশাখলগ্ন দেখি নদী বয়ে যায়। তুমি জবা, তুমি রজনীগন্ধা। দেখো এই দুইপাড়ে জেগেছে গান। দেখো একমুখ বাঁশীওয়ালার দাড়ি। দেহ থেকে খসে খসে পড়ছে তারকা গাড়ি। অথচ প্রত্যেক রাতে নষ্ট হয়ে যাবো ভাবি। রাতকে করি ফালি ফালি। বাণিজ্যের ফ্লোরিংয়ে এখনো দু-তিনদিন বেঁচে থাকি। ট্রেসিংপেপারে ইচ্ছে মতন মন আর মনহীনের কেমন এক যৌগিক মিল, দেখি। তবুও পৃথিবীতে দেখি নি কোথাও একটি মনের প্রমাণ।

মহাকাশের দিকে যে মেয়েটি
হাঁ করে তাকিয়ে আছে
তার পক্ষে উড়াল সম্ভব।
এই ধরনের আকুতির সংগ্রামে
আমিও প্রস্তুত প্রভু,
কিশোর কেবলই ভাসতে পারে
যেদিকে ঢেউ যায়
মেঘলা বনে,
এমন কিশোর কি উড়তে পারবে কভু?
সাঁতারে ভাল না
আষাঢ়ে বৃষ্টি কই?
আমার তাই মহাকাশই ভাল
পছন্দের ফুল
ডানাতে বিদুৎ
ঝর্ণার দর্শণে মালগাড়ী গিয়ে থামবে
মহাস্টেশন রোড। নতুন পোশাক পড়ে জ্বলে ওঠবে পুরাতন ডাকঘর, রাগী রোববার।

পরাগ আজিজ


ঘুরে ফিরে বারবার নিজের সাথেই দেখা হয়


মানুষ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে প্রাণী
মানুষ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে পাখি
মানুষ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে কীট-পতঙ্গ।

প্রাণী রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে মানুষ
প্রাণী রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে পাখি
প্রাণী রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে কীট-পতঙ্গ।

পাখি রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে মানুষ
পাখি রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে প্রাণী
পাখি রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে কীট-পতঙ্গ।

কীটপতঙ্গ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে মানুষ
কীট-পতঙ্গ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে প্রাণী
কীটপতঙ্গ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে পাখি।

মানুষ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে উদ্ভিদ
প্রাণী রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে উদ্ভিদ
পাখি রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে উদ্ভিদ
কীটপতঙ্গ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে উদ্ভিদ।

উদ্ভিদ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে মানুষ
উদ্ভিদ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে প্রাণী
উদ্ভিদ রূপান্তরিত হয়ে হয়ে হচ্ছে পাখি
উদ্ভিদ রূপান্তরিত হয়ে হচ্ছে কীটপতঙ্গ।

সবাই পেয়ে যাচ্ছে সব জীবনের স্বাদ
এভাবে ঘুরে ফিরে বারবার
আমার নিজের সাথেই দেখা হয়!

আত্মগোপনে বেঁচে থাকি


হঠাৎ একদিন
আত্মগোপনে চলে যাবো
ভীষণ আহ্লাদে
মেঘেদের জল কুড়াবো।
আমাকে খুঁজবে...
খুঁজে খুঁজে
ক্লান্ত তুমি কী
কেঁদে বুক ভাসাবে!
আহা খুঁজবে
একা আত্মগোপনে আমি;
আমার মৃত্যুর পরেও
হয়তো, বহুদিন ফিরে
আসার অপেক্ষায় থাকবে।
আত্মগোপনে বেঁচে থাকি
প্রতীক্ষার হিরণ জলে।

খন্দকার নাহিদ হোসেন


ভূত


তোমায় বলি না-কাঁধে একসময় দাগটা ছিল
ছিটেফোঁটা রক্ত...এখনো হয়তো
কোন পুরনো জামায়;

আমি আলমারি কোন ঘরে ভুলে যাই
দক্ষিণের বারান্দায় লেবু কাঁটা বুনি
যেই হাত খুব থরথর করে-
তাকে বেঁধে রাখি...বেঁধে রাখি।

অঞ্চলের নাম বুড়ো হয়-ভাঁজ বাড়ে...
আমরাও একটু একটু?

আনাচের হাঁটে দিন হারিয়েছি বলে
সন্ধ্যায় ভীষণ কান্না আসে
ঘাস বাড়বার উঠোনটা যায় ভরে
জংলার পুদিনা হাতায়...
বুঝলে-
আস্তে কাঁপে রাত-আস্তে আস্তে।

আমি কিন্তু এইসব কাউকে বলি-টলি না
মরে যাই...মরে মরে যাই
আর থরথর করা হাত-সেই হাত
বেঁধে রাখি...বেঁধে রাখি;

লোকে শুধু দেখেছিল পুরনো দাগের শার্ট?


ঘোর


কষ্টরা বীরুৎ শ্বাসে গলার ভিতর
হাঁপ ধরে যায়, মনে হয় হাতে ধরা কুটো শিশি
গ্লাস দাও...দাও অসুর বর্ষণ
আমিও বাতাস...বুকে ভরে শুনি-সেই ধুকধুক
নক্ষত্রের ফোঁটা

বন্ধু বলো কিংবা একদিন ভালোবাসা-অনেক সাঁকোতে
বাঁচে; তুই একদিন-তুমি একদিন...
সব তবু ডোবে ইমামবাড়ায়-হোসেনীর বাঁকে?

মানে কী কষ্টের-অনুবাদে কাকে লিখি
ডোকরানো কান্না চুপি চুপি আয়নায়-যে জগতে পুষি
হয়তো তাহাই ঠিক-চোয়ানো শৈবাল হাত
ঘুঙ্ঘুর আড়িকে চেনে, হাতছানি চেনে, আউলানিও...
হয়তো তাহাই শিল্প...বৃশ্চিকের যাদু-
ফোটে না মহান সুখ-ঝুরো রেণু দানা...অনুবাদে;

তোমাদের চরাচরে সেসব কেমন-গলায় ঘাসেরা জাগে?
এতো মৃত্যু, ছুটে চলে যাওয়া...একলা একলা পাখিদের বন
কোথাও কখনো মনে হয়-
তুমি থাকলে আকাশ অন্যরকম হতো?

বন্ধু বলো কিংবা একদিন ভালোবাসা-অনেক সাঁকোতে
বাঁচে; তুই একদিন-তুমি একদিন...ভেক্টরের মান
নক্ষত্রের ফোঁটা?

আমাদের বিস্তৃতিই ধ্রুব-আলাপের কাল, জেগে থাকা
তক্ষক নালিশ...এইসবই সব-রূহ বীজ ছায়া  
কয়েক থিরের আয়ু...নুন পোড়া গুল্মে তাজিয়া মিছিল;
এরই ভিতর টগরে ছুঁড়লে ঢিল দরিয়ারা জাগে...
কিনারায় যায় দেখা-আঘাত মন্দির?

প্রবারনায় কেমন আমি উড়ি...ভেবেছি অনেক
ধুয়ে দিলে বুঝি সাবানও হারায়-প্রেমেদের ছাঁচ
জল তাই সব?
গ্লাস দাও...দাও অসুর বর্ষণ-হয়তো ইহাই শিল্প...
বৃশ্চিকের যাদু-

তোমাদের চরাচরে সেসব কেমন-গলায় ঘাসেরা জাগে?
এতো মৃত্যু, ছুটে চলে যাওয়া...একলা একলা পাখিদের বন
কোথাও কখনো মনে হয়-
আমি থাকলে আকাশ অন্যরকম হতো?

মাজুল হাসান



সাইকেল তবু বসন্তবাহক


১.
চেনা পথেও ছায়াগিমিক। অচেনা নারীর ভজনা হলো শুধু
এখন বৈভবজুড়ে পতন, কাকচক্ষু জল, ইস্পাত-ফুল ধূধূ
চাইলে চলে যেতে পারি সুগোলের বাড়ি, মেরু-বিচ্ছূরণসম
হয়েছি রঙান্ধ, চিনতে পারিনি কথা বলা পাখি—প্রণয়সম্ভার
গান গায় ক্রিস্টালের পাখি, ধনুকের ছিলা, আহত হুঙ্কার
আমার সম্বল তাই ডানাবিদ্বেষ, পাথর, স্মৃতিকর্পূর ক্ষম ক্ষম
যে কুঠার সবুজ চিবায়; তারও শরীরে বৃক্ষ-বৃক্ষ শোক
উঠেছে খড়ি, বেয়ারিংয়ে জং—সাইকেল তবু বসন্তবাহক...

২.
বাজো খঞ্জন—চেনা নারীর বুকে গড়াক অপরিচিত ফল
দস্যু থেকে নিবিড় রথ হয়ে যাওয়া অলৌকিক সবুজ বন
প্রতিটি মোহহীন লামা-মন্ত্রের সারসংক্ষেপ এই দূরবীক্ষণ
তোমার ত্রয়দশ অবতারের কিংবদন্তিতে গলে গলে জল
একদা বৃক্ষচূড়ে আগুন—অভিমানে পোড়ে সমূহ ফটোগ্রাফ
যেদিকে তাকাই, দেখি—ফুটেছে আনুভূমিক ক্রিসেনথিমাম
বাবার কড়া-পড়া হাত, ঘাম; আমাদের কচ্ছপের গ্রাম
আকাশগঙ্গায় স্মৃতিঝড়। তারাকঙ্কাল খুটে খায় মস্ত জিরাফ...

৩.
গোলাপ-কণ্টকে যাওয়ার কথা ছিল যুগল পাদুকার
যেখানে চুপ-নদীতে পীতসবুজ সম্পর্ক ভীষণ মন্থরে
টিপ্পনী কাটে। জ্বলন্ত বৃষ্টিবিদ্ধ শকট; ঘন শালবীথিকা
এতো পরিষ্কার সবুজ—খুব জোরে প্রেমিকার নাম ধরে
ডাকতে পারি না৷ তবে রুমালে লেখা এইসব ফ্লু'র মৌসুম
সমুদ্রঘটক, প্রেমটুকু শুধু থাক। কৈশোরের পুনর্ভবার
বুকে তইতই করুক গোধূলি-হাঁস। প্রেমাস্পদ আমার
চণ্ডাল সাইক্লোন আইয়ের ভেতর দেখি শ্রান্তির ঘুম...

৪.
যতটুকু নিধি-লাবণ্য তারও অধিক বাষ্পাধার
হিমপ্রত্যুষে নারীর রিনিঝিনি নীরবতার সন্তান
ডুবে থাকে কোমল-অঙ্গার, ব্যালকনির ভগ্নগান
যেখানে পতন সেখানেই লিরিক; তীর্থ-সংসার।
শিখি ভূমিজরিপের যন্ত্র, চুম্বক, অতঃপর জল
লৌহ-গলনাঙ্ক পাঠশালা ওদের, গোত্র ধূলিঝড়
'শ্বাসরোম শ্বাসরোম' স্লোগানে ওড়ে মর্মর-মর্মর
জীবন এক ল্যাবরেটরি—সমুদ্রবাস; রহস্যফল

মিছিল খন্দকার



দৃশ্যের বীভৎস নন্দন


প্রাসঙ্গিক অনিচ্ছায়
মৌন থাক দুপুরের প্রকৃত কারণ।
দাঁতে নখ কাটার উদাসিনতা
সূর্য ডোবার আগে কিছুটা বিষণ্ন থাক,
এতে তার অধিকার আছে।
দুঃখ থেকে কান্না ছেঁটে নিয়ে
এই বসে থাকার সমূহ ভার
নিয়ে সাবলীল নদীর আঁধারে
তরঙ্গ তুলে ডুবছে নুড়ি
আমার করতল থেকে তাকে ছুড়েছে যে কে
বেখেয়ালে!
তার ভাবনায় যে নৈরাজ্যময় গুঞ্জরণ
জলের তুমুল ক্রোধে তাতে জ্বলুক আগুন মোহনায়
কেননা দৃশ্যের নন্দন নিয়ে কী বিভৎস দাবানলে
পুড়ে গেলে বন
কেউ কেউ ছবি তুলে রাখে!

কান্না


অর্ধপরিচিতের সামনে কোনো বিমূর্ত কারণে মুষলধারায় কান্নার পর যেমন লাগে তেমন একটা লাগা বহুকাল হলো জাপটে ধরে আছে। দূর থেকে লঞ্চের ভেঁপু আসবে, মৃত্যুর মতো অনতিদূরের বিষণ্ন ভেঁপু- নদীর এমন নিকটে একটা নির্জন বাড়ির কথা ভাবি মাঝে মাঝে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। খোলা শষ্যক্ষেতে রাতে চোখ দু'টো খুলে পড়া কৃষকের অস্থির হাতড়ানো দু'টো হাত তখন বুকের মধ্যে নড়াচড়া করে। তার আঙুলে বাজা কম্পিত ব্যথায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। রাতকে তখন আবারও অর্ধপরিচিতের মতো মনে হতে থাকে। নিজেকেও মনে হয় অপরিচিত। নিজের সামনে তখন হাউমাউ করে কাঁদতে আমার কেমন যে লাগেরে মিথুন!

শফিকুল রাজু



কুমারী বাতাস



চটি, ওড়না ফেলে ছুটে যায় করবীর মতো লাল কুমারী বাতাস
মেট্রোপলিটন সিগন্যালে মাল্টি আলো… আর ক্রিয়াশীল ছুড়ির
ফলার মতো ধারালো মানবিক দাঁত… হেডলাইট জানেনা, হিম
জানেনা… কেন স্টিল দাঁড়িয়ে আছি!

সিগারেট ধূয়াতে ঘন পৌষ কুয়াশার রাত জানে…


মণিকারা জানে


উৎসর্গ: মজনু শাহ প্রিয়বরেষু

মণিকার বেণিতে ফিতা বাধার ছলে যে পেয়েছিলো পুষ্পের ঘ্রাণ… সে মাতাল হয়েছে,
মণিকার কাজিন ছিলো না… পিসতোত বোনের বর ছিলো যে… গোপনে অনেকবার
মণিকার ফ্রকের বোতাম, বেল্ট লাগিয়েছে… বর! হুম, বরই তো; অনেকরাতে ঘুমন্ত মণিকার
ঘরে দেখা গেছে তাকে ঢুকে পড়তে।

তোমরা জানো না, মণিকারা জানে… নাসপাতি বনে কারা গোপনে রেখে যায় মিষ্টি বেদনা

প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়



ঘুণপোকাদের ক্লাবঘর


শরীর যেখানে থই পায় না
সেই অন্ধকার স্নায়ুজাল আমাদের বাঁচিয়ে রাখে
আর আমরা ভুলের খেসারত দিতে দিতে ভুল করি

জীবনের নুনই জীবনকে চালায়
নাকি জীবন
নুনের হিসেব লিখতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে
শূন্যের দশমিক স্থান

এরকম দ্বিধা ও কুয়াশার যে বসতবাটি
যে জনপদ
আদার ব্যাপারী আর জাহাজের মায়া
তাকেই আমরা সংসার বলি
সম্পর্ক বলি
যৌনলেফাফা সেখানে একটানে খুলে ফেলা হয়
আর আঠার অভাবে দীর্ঘদিন
হাঁ-মুখ নিয়ে পড়ে থাকে

এর মধ্যে দিয়েই আমাদের ইতস্তত মিছিল
একা সিগারেট
মদ খাওয়ার আগের হুল্লোড় আর পরের চিৎকার

এর মধ্যেই আমাদের ফোন বাজে
আমরা ধরি
আমরা ধরি না
আমাদের অজুহাত আমাদের ছাপিয়ে ওঠে
বিষন্ন হবার কথায় হাসতে থাকি
আর হাসলে
সন্দেহ করতে শুরু করি

একটা পাথরের সংশয় তখন আমাদের কুরে খায়

একটা উই সরণী আমাদের মাথার লোভে ঘুরঘুর করে
ঘুণপোকাদের ক্লাবঘর রাতারাতি নীলসাদা  ভোল পাল্টে
শিরদাঁড়া বরাবর আড্ডা জমায়

তুমি খুন করতে পারছ না
তুমি আত্মহত্যা করতে পারছ না
তোমার নিজস্ব হ্যারিকেন
গাঁয়ের বটতলায় ভেঙে এসেছ
আর এসেই মেতে উঠেছ ক্ষয়ের উৎসবে
মেতে গেছ তরজায়
মেতে গেছে তর্জনী

ব্যবহার করছ ব্যবহৃত হচ্ছও
আর জল কিছু মনে রাখছে না বলেই
তাকে ভয়

যার স্মৃতি নেই সংবেদ নেই
নেই নিজস্ব চোখ অথবা চশমা
এরকম প্রলয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
তুমি কোন স্তোত্রগাথার কথা লিখবে
এরকম কোন উচ্চারণ করবে তুমি
যা হাওয়া ও আগুন বয়ে নিয়ে
সময়ের ধাতব কাঁটায় আছড়ে পড়বে

বন্দরে বন্দরে রাসায়নিক অভিযোজন চলছে
আর তুমি হাত রাখলে
গাছ ছাই হয়ে যায়...

রঙ্গীত মিত্র



বউ


পুরুষেরা, ঘুরপাক খায়
দলাদলি, জাত বেচে দেয়
শিক্ষার থেকে উঠে আসে
মধ্যপন্থা।
আমি তবু বিদেশি কাগজ পড়া
অন্যের জামা, নিজের গায়ে চড়িয়ে,
স্বপ্নে শ্রীলেখা মিত্রকে দেখি

কিন্তু নিজের বউকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিই না।

ঠকে যাই


কখন আসে না, আবার এক সাথে অনেকেই আসে
আমি তাদের জুতো, জামা-কাপড় দেখি।
কিন্তু বয়স বাড়লেও, বোধ বদলাচ্ছে না
বরং মুখোশ পরা লোকদের ভিড় বাড়ে
আর আমি চিনতে পারি না বলে, ঠকে যাই।

পরখ


একরকম করবো, প্ল্যান করে
আরেকরকম করি।
ধান্দাবাজী, আমার প্যান্টের চেন থেকে
মুখ বাড়িয়ে, জানায়
আমার শরীরটা
একটা বর্ণমালার মতো।
তবু দাদা, একবার কাছে
টেনে নিয়ে আসার আগে
পরখ করে নিন।

জিহান


অস্তিত্ব এবং অবিশ্বাস!


পবিত্র আত্মা খুঁজতে খুঁজতে আমরা এক শিশুর
পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসলাম।
শিশুটির আপন মনে খেলার মাঝে আমাদের
আবির্ভাব সাময়িক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল
অথচ আমাদের পা, চোখ ও হাত এক পলকে
চোখ বুলিয়ে ফিরে গেল সে আপন বৃত্তে।
আমরা উত্তেজিত বোধ করছিলাম প্রশ্ন এবং
উত্তরের ইন্টারভালে।
অবিশ্বাস-ই অন্ধকার এমন উপলদ্ধি তে আমরা
সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না।
শিশুটি কিছুই জানতো না।
অথচ প্রগাঢ় স্বস্তি ও শুভ্রতা নিয়ে
হাসছিলো এক নির্মল শান্তিময় বাতাসের
সাথে।
আমরা অসহায় বোধ করছিলাম সময়ের তাড়া
এবং সকল প্রশ্ন এবং উত্তরে।

অথচ কোন এক গভীর বৃষ্টিস্নাত সন্ধায় আমরা প্রার্থনায়
বসেছিলাম।
মোমের আলোতে অন্ধকার
সরিয়ে ফিরে যেতে চেয়েছি সেই শিশুটির
চোখে।

নাহিদ ধ্রুব


দৈনিক সার্কুলার


চারপাশে বস্তির মতো শহর, স্থিরচিত্রের মতো
বুকে ঝুলিয়ে রাজপথে হেটে বেড়াচ্ছে লক্ষাধিক
হিউম্যান বোম্ব।
তাদের পিছনে ছুটছে গ্রামতাড়িত কুকুর
প্রাণচিহ্নময় জনপদে শ্মশানের সুর আর
সভ্য শহরে সাধারণ ভাতকাপড় লাফিয়ে পালাচ্ছে।

এই কমপ্লেক্স প্রসবে ভবিষ্যৎ আটকে যাচ্ছে আঁতুড়ঘরে
জুয়ার আসর থেকে পানশালাতে ধারদেনা যেন
আত্মহননের প্রতিরুপ। ট্র্যাফিকনগরে পাগল উৎসুক।

তারপর অগনিত জখম দূর্বাঘাসে মুছে
দিনশেষে
সসংকোচে ডানা ঝাপটানো পাখি ফিরে
সর্বনাশে
বস্তির মতো চারপাশে দম নেয় খুপচি শহর
যার দেয়ালে দৈনিক সার্কুলার ঘেমে যাচ্ছে।

ইচ্ছেশ্বাস


আমরা সে'ই বাধ্যগত কৃতদাস।
ঘুম ভেঙে গেলে যাদের চোখে জন্মায় জলের খনি।
প্রতি সকালে একটি এতিম গাছ সেখানে গোসল করে
ময়লা কাপড় বুকে মুক্তোদানার লোভে ডুবে যায় ডুবুরী

একদিন জাবর কাটা রাখাল দেখতে পায় ঘাসফড়িঙ
উড়ে যাচ্ছে, ভাত খেতে খেতে দেখা গেলো
কৃষক মরে যাচ্ছে ; অনাহারে। আর যে ভিখারিপুত্রের
নাম রাখা হয়েছিল পাইলট সে ফিনফিনে কাগজ
উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে।

পাতার গায়ে লেগে থাকা পথ অনুসরণ করি
নুড়িপাথরের গ্লোব বগলদাবা করে খুঁজি শুন্য বিষণ্ণতা
যেখানে জানা যায় -
অপেক্ষাজনিত রোগে আক্রান্ত আমাদের ব্যক্তিগত
দীর্ঘশ্বাস গুলো একদিন আমাদের ইচ্ছে ছিলো...